মুনসুর রহমান তানসেন কাহালু থেকেঃ দক্ষতা ও কঠোর পরিশ্রম মানুষকে তাঁর স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। সফল অনেক মানুষের পিছনের গল্প থেকে সেই উদাহরণ উঠে আসে। দেশীয় প্রজাতির শিং মাছচাষে মো. লোকমান হাকিম সওদাগরের স্বপ্নপুরুণের পিছনের অনেক গল্পই এ প্রতিনিধিকে জানালেন কাহালু উপজেলা সিনিয়ার মৎস্য অফিসার নূর নবী ও লোকমান হাকিম নিজেই।
লোকমান হাকিম ১৯৮১ সালে বগুড়া সদর উপজেলার গোহাইল রোডে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মাহবুর রহমান সওদাগর জীবন যুদ্ধে অনেকটা দরিদ্রতার সাথে কাটিয়েছেন। আশির দশকে শত কষ্টের মধ্যে থাকা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের মানুষের মত মানুষ করার প্রাণপন চেষ্টা করে তিনি সন্তান লোকমান হাকিমের সফলতায় নিজেও একজন সফল পিতা। লোকমান হাকিম তিন ভাইরের মধ্যে সবার বড়। তিনি ৮ম শ্রেণি পাশ করার পর লেখাপড়ায় মন না বসায় তাঁর উদসীনতায় পিতা-মাতা অনেকটা হতাশায় পড়েন।
স্থানীয়দের কটু কথায় মন বিষিয়ে উঠা লোকমান হাকিম ঢাকায় গিয়ে একটি ফাক্টরীতে কাজ নেন। সেই কাজেও মন না বসায় তিনি বাড়িতে এসে স্বপ্ন দেখেন বিদেশ গিয়ে টাকা-পয়সা ইনকাম করে দেশে এসে একটি পুকুর করে সেখানেই করবেন মনের মতো বসতি। অনেক কষ্ট্ েতিনি টাকা সংগ্রহ করে তিনি ১৯৯৮ সালে লেবাননে যান কাজের সন্ধানে। সেখানে গিয়ে তিনি মাছচাষ ও কৃষি কাজে সম্পৃক্ত হন। সেখান থেকে মাঝে মধ্যে তিনি দেশে আসেন। ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে জালাল সওদাগরকে লন্ডনে ও ওছমান সওদাগরকে লেবাননে পাঠান। জালাল সওদাগর লন্ডন আছেন এবং লোকমান হাকিম ও ওছমান সওদাগর দেশে চলে আসেন।
লেবাননে প্রায় ২১ বছর কাটিয়ে ২০১৯ সালে লোকমান হাকিম তাঁর ছোটবেলার স্বপ্নের সেই কাজটি শুরু করেন। সেখানে মাছচাষের দক্ষতা অর্জন করে তিনি প্রথমে কাহালু উপজেলার মালঞ্চা ইউনিয়নের ভালশুন লোহারপাড়া এলাকায় তিনটি পুকুরে শিং মাছচাষ শুরু করেন। শিং মাছচাষে ব্যপক সফলতা অর্জন করায়, সেখানে তিনি আরও জায়গা কিনে আরও সাতটি পুকুর করেন। সেখানে ছোট পরিসরে মৎস্য খামার ও একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। এভাবেই তিনি নিজ পরিবারের লোকজনের প্রেরণায় ১০ টি পুকুরে শিং মাছচাষ করে তিনি উন্নতির দিকে ধাবিত হন।
এদিকে তাঁর সফলতায় এগিয়ে আসেন উপজেলা সিনিয়ার মৎস্য কর্মকর্তা নুর নবী ও উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর। আধুনিক প্রদ্ধতিতে নিরাপদ মাছচাষের জন্য লোকমান হাকিমকে দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ। উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের কারিগরি সহযোগিতায় লোকমান হাকিম নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পৌঁছে যান তাঁর স্বপ্নের ঠিকানায়। মাত্র ৩ টি পুকুর থেকে নিজস্ব ১০/১২ টি পুকুরসহ বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় লীজ নিয়ে প্রায় ৫৫ টি পুকুরে তিনি মাছচাষ করছেন। তিনি প্রতি বছর প্রায় ৮ হাজার মন শিং মাছ উৎপাদন করে দেশের মানুষের আমীষের চাহিদা পুরুণে সহায়ক ভ‚মিকা করছেন।
উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে শিং মাছচাষে প্রতি বছর লোকমান হাকিম আয় করেন প্রায় দেড় কোটি টাকার মতো। এছাড়াও সফল মাছচাষি হিসেবে তিনি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছেন। সফল মাছচাষি লোকমান হাকিমের ভালশুন লোহারপাড়ায় গড়ে উঠা আলিয়া মৎস্য খামার এখন অনেক মাছচাষির শিক্ষণীয় বিষয়। সেখানে উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের কারিগরি সহায়তায় করা হয়েছে শিং মাছের প্রদর্শনী। তাঁর খামারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বেশ কয়েকজন বেকার মানুষের। অন্যান্য খামার মালিকদের চেয়ে তিনি কর্মচারীদের প্রায় ৫ হাজার টাকা বেশি বেতন দেন। যারফলে কর্মচারীরাও নিজের উন্নতির পাশাপাশি লোকমান হাকিমের খামারে স্বাচ্ছন্দে মাছচাষের কাজ করেন।
আগে এই অঞ্চলে শিং মাছচাষে অনেকে আগ্রহী ছিল না। লোকমান হাকিমের সফলতায় এখন সেই এলাকার জাকারিয়া, মামুন, বাদল, রেজাউল ও সজিবসহ অনেকেই এখন শিং মাছচাষ করে অনেকটা সফলতার পথে। লোকমান হাকিম জানান, ছোটবেলায় দেখা স্বপ্ন আমার পুরুণ হয়েছে। এখন আমার ইচ্ছা বড় বড় পুকুর নিয়ে মাছচাষের আরও প্রসার ঘটানো। সেখানে যাতে অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় সেই চেষ্টায় আছি।
উপজেলা সিনিয়ার মৎস্য অফিসার নুর নবী জানান, মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে শিং মাছচাষে লোকমান হাকিম উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছেন। তাঁর সফলতার গল্প শুনলে অনেক মাছচাষি উপকৃত হবে। বর্তমানে মাছচাষের উপর লোকমান হাকিম জাতীয় পুরুস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
সোনাতলা সংবাদে লিখতে পারেন আপনিও। যে কোনও তথ্য ও ভিডিও দিন নিচের WhatsApp নাম্বারে। প্রয়োজনে আপনার নাম ও পরিচয় গোপন রাখা হবে।
মোবাইল: ০১৭৭৪৬৫০৬৭১
E-mail: sonatalasangbad@gmail.com