কাহালু (বগুড়া) প্রতিনিধিঃ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার আতপুর জাগৃতি থিয়েটারের আমন্ত্রণে আগামী ২০ সেপ্টেম্বর বগুড়া জেলার ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠন কাহালু থিয়েটারের ১৭ সদস্যের নাটকের দল ভারতে যাচ্ছে।
উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগর রবীন্দ্রভবনে জাগৃতির ৫৯ তম বাৎসরিক ৭ দিনব্যাপী নাট্যোৎসবের ৪র্থ দিন ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, গ্রæপ থিয়েটার ফেডারেশন ও বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সক্রিয় সদস্য কাহালু থিয়েটার মঞ্চায়ণ করবে সেতারা বানুর কিচ্ছা নাটক।
শিকড় সন্ধানী নাট্যকার ও আধুনিক বাংলা নাটকের প্রাণপুরুষ ড. সেলিম আল দীন গ্রাম থিয়েটার কর্মীদের যে, পথ দেখিয়ে গেছেন, সেই ধারাবাহিকতায় বর্ণাতœক রীতি ও লোকপালার আঙ্গিকে এই নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন আব্দুল হান্নান। শাহাজাদ আলী বাদশার রচনায় এই নাটকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশ বিরোধী অশক্তির বিরুদ্ধে লড়াকু এক সংগ্রাম নারীর গল্প তুলে ধরা হয়েছে।
জানা গেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নাটকটি মঞ্চায়ণের জন্য প্রতিদিনই কাহালু থিয়েটারে মহড়া চলছে। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর কাহালু উপজেলা অডিটোরিয়াম হলে এই নাটকের প্রস্তুতি প্রদর্শনী করা হবে। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করবে আব্দুল হান্নান, শাহাজাদ আলী বাদশা, ফরিদুর রহমান ফরিদ, মুনসুর রহমান তানসেন, টুটুল, সাইদুর রহমান, পংকজ কুমার মুখার্জী, শাহাদত, বাবু, অতুল, ফারহা রহমান স্মৃতি ও গুলশান আরা।
সেতারা বানু নাটকে মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশ বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে এক লড়াকু সংগ্রামী নারীর গল্প তুলে ধরা হয়েছে। সেতারা বানুকে ঘিরেই নাটকটির মূল গল্প। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারেরা পাকবাহিনীকে দিয়ে হত্যা করে সেতারার বাবাকে। সেতারার মাকে তুলে দেওয়া হয় পাকবাহিনীর হাতে। পাকবাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত সেতারার মাকে গ্রহন করেনা সমাজের লোকজন। একমাত্র শিশুকন্যা সেতারাকে রেখে লোকলজ্জার ভয়ে আতœহত্যা করে সেতারার মা।
সেতারা মানুষ হয় দিনভিকারী দাদা দবিরের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সব হারানো দবির ভিক্ষা করে সংসার চালায়। অপরূপ সুন্দরী সেতারা বানুর উপর ক্যু-দৃষ্টি পড়ে রাজাকার পুত্র মমিনুলসহ অনেকের। সংগ্রামী নারী সেতারা নিজেকে রক্ষার জন্য চাঁনকে ভালোবাসে। পোদ্দারের কথামত না চলার কারনে একদিন সেতারার দাদা দবিরকে গুম করা হয়।
সেতারা মমিনুল কতৃক অপহৃত ও নির্যাতিত হলেও গ্রাম্য শালিসে চাঁনের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চলে। নির্যাতিত সেতারা কৌশলে প্রতিশোধ নেওয়া পরিকল্পনা করে। এক রাতে পোদ্দার ও তাঁর ছেলে মুমিনুলকে সেতারার বাড়িতে কৌশলে ডেকে আনা হয়। এরপর সেতারা ঘরের ছিকল তুলে দিয়ে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পোদ্দার ও মুমিনুলকে পুড়িয়ে মেরে নিজেও আতœহত্যা করে। এক লড়াকু সংগ্রামী নারীর জীবনের বিষাদের কাহিনী নিয়েই সেতারা বানুর কিচ্ছা নাটকের মুল গল্প।
জানা গেছে কাহালু থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক শাহাজাদ আলী বাদশার রচনা ও সভাপতি আব্দুল হান্নানের নির্দেশনায় সেতারা বানুর কিচ্ছা নাটকের বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হয়েছে। ইতিপূর্বে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদাহ জেলার গাজোলে বিষাণ একটি নাট্য সংস্থার উৎসবে এই নাটকটি মঞ্চায়ণ করা হয়।
শেকড় সন্ধানী নাট্যকার ও আধুনিক বাংলা নাটকের প্রাণপুরুষ প্রয়াত ড. সেলিম আল দীন ও শিল্পপিতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসংখ্য দেশপ্রেমিক মানুষদের নিয়ে আশির দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের যাত্রা শুরু করেন। গ্রাম থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার পর ড. সেলিম আল দীন ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর আহবানে প্রথম পর্যায়ে ১৯৮৩ সালের ২৩ মে বীরমুক্তিযোদ্ধা কৃষিবিদ বজলুর রশিদ রাজা একঝাঁক তরুণ নাট্যকর্মীদের একত্রিত করে প্রতিষ্ঠা করেন কাহালু থিয়েটার।
মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাঙালি জাতির এক অস্থির ছিন্ন ভিন্ন লক্ষ্যহীন গন্তব্য পথে দুঃসময়ে বাঙালি জাতির শৃৃঙ্খল মুক্তির জয়গানে অবির্ভূত হয় কাহালু থিয়েটার। কাহালু উপজেলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের মৌলিক ভাবনার সঞ্চারিত শক্তি কাহালু থিয়েটার। যুক্ত হন বীরমুক্তিযোদ্ধা, মাঠের কৃষক, শ্রমিক, দোকানী, নি¤œ আয়ের মানুষ, সামাজিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃৃন্দ ও প্রশাসনের সার্বিক অংশগ্রহনে কাহালু থিয়েটার হয়ে ওঠে গণ মানুষের সংগঠন।
গ্রাম থিয়েটারের উজ্জবনী শক্তিকে অভিজ্ঞতায় নিয়ে নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল দীন ও শিল্পপিতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর দেখানো পথে কাহালু থিয়েটার সৃষ্টি করে নিজস্ব নাট্যকার। জিয়াউল আলম ধুমকেতু, প্রয়াত আবু সাইদ মিন্টু, শাহাজাদ আলী বাদশা, আব্দুল হান্নান, রফিকুল ইসলাম, মুনসুর রহমান তানসেন এর লেখা নাটক দিয়ে প্রাণ সঞ্চারিত হয় কাহালু থিয়েটারের। এদের উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে বেজম্মার গোষ্টি, সেতারা বানুর কিচ্ছা, ভয়াল রাত্রি, বিষনালা, ক্ষত, তৃতীয় নয়ন, বানে বাঁচাও মাও গেদা, অঞ্চলের একাত্তর, নয় অপমৃত, বিরঙ্গনার কথা, ও বাঙ্গালীর বঙ্গবন্ধু।
নিজস্ব নাট্যকারসহ দেশের সুনামধন্য নাট্যকারের অসংখ্য মঞ্চ ও পথনাটক মঞ্চায়ণ করে, নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আজও কাহালু থিয়েটার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মঞ্চের পাশাপাশি বিটিভি, এটিএন বাংলাসহ বিভিন্ন চ্যানেলেও কাজের সুযোগ পেয়েছে কাহালু থিয়েটারের নাট্যশিল্পীরা। দেশের গন্ডি পেড়িয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দূর্গাপুর, রায়গঞ্জ, গাজোলে ইতিপূর্বে কাহালু থিয়েটার আমন্ত্রিত হয়ে নাটক মঞ্চায়ণ করেছে।
সেই ধারাবাহিকতায় আগামী ২১ সেপ্টেম্বর জাগৃতি থিয়েটারের আমন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার শ্যামনগর রবীন্দ্রভবনে কাহালু থিয়েটার মঞ্চায়ণ করবে নিজস্ব নাট্যকারের লেখা সেতারা বানুর কিচ্ছা নাটক।
Leave a Reply