মতামতঃ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্যতম একটি উপাদান নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময় পর নতুন একটি সরকার আবির্ভূত হয়। সেই সরকার নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে দেশের কল্যাণে কাজ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে নানামুখী জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এসব জটিলতার কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে বিভিন্ন সময় স্বৈরাচারিতা ও ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হচ্ছে। তাই এখনই সময় সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বার্থে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।
সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে নিচের সংস্কার কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
১। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে হবে। যদি তাদের দূরে রাখা সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক নেই এমন শিক্ষক-কর্মচারীদের খুঁজে তাদের দায়িত্ব দিতে হবে। তারা অঙ্গিকারনামা বা হলফনামা দেবে যে তারা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নয়। পরে তাদের দলের সাথে সম্পর্ক আছে এমন তথ্য প্রমাণিত হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২। ভোটকেন্দ্রে একই ব্যক্তি যাতে বারবার ঢুকতে না পারে সেজন্য প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে।
৩। ভোটকেন্দ্র গোপন কক্ষ ছাড়া কেন্দ্রের সবকিছু সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। জনসম্মুখে বড় মনিটর দেয়া থাকবে। সাধারণ লোকজনকে সেই মনিটরে সেগুলো দেখার সুযোগ দিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন এটির ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে।
৪। ব্যালটপেপার সকালে কেন্দ্রে পৌছে দিতে হবে। দুর্গম এলাকায় নির্দিষ্ট একটি স্থান থেকে সকালে ব্যালটপেপার সংগ্রহ করবে। সে প্রক্রিয়াটিও সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে এবং জনসাধারণকে দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
৫। ভোটকেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণার পরে কোন সহিংস পরিস্থিতির উদ্ভব হলে যে প্রার্থী এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘটনার সাথে যদি বিজয়ী প্রার্থীও জড়িত থাকে তারও ভোটের ফলাফল বাতিল করতে হবে। কমপক্ষে দু’টি সংস্থার মাধ্যমে সহিংসতার ঘটনার তদন্ত করতে হবে।
৬। প্রচার-প্রচারণায় কেউ বাঁধা দিলে এবং তা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর প্রার্থীতা বাতিল করতে হবে। এক্ষেত্রেও দু’টি সংস্থা তদন্ত করবে।
৭। দায়িত্বরত পিসাইডিং অফিসার যেন সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার বাইরের হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁর আবাস বা গ্রামের বাড়ি যেন কোনক্রমেই সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় না হয়। সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম করতে হবে।
৮। এক নির্বাচনী এলাকার প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের পার্শ্ববর্তি নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনী দায়িত্ব দিতে হবে। কোনক্রমেই এক নিজ নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্ব দেয়া যাবে না।
৯। প্রধান নির্বাচন কমিশনার থেকে শুরু করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সর্বনি¤œ ধাপের কর্মকর্তা বা কর্মচারীর কোন অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে তার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদ-সহ সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখতে হবে।
১০। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা তত্বাবধায়ক সরকারের কেউ ভবিষ্যতে রাষ্ট্রপতিসহ লাভজনক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভ করতে পারবেন না। এবং তারা রাজনৈতিক দল করতে পারবেন না এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
১১। জাতীয় সংসদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদসহ সকল নির্বাচনে কেউ দুইবারের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেন না। তবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানদের জন্য বিষয়টি প্রযোজ্য নয়। তারা বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেলেও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধান দুইবারের বেশি হতে পারবে না।
১২। ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করেছে অথবা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে তাদের ভবিষ্যতে সকল নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে নিষিদ্ধ করা।
১৩। সংবিধানে নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকারের বিধান সন্নিবেশ করতে হবে। ওই সরকারের নাম হবে নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকার। এ সরকারের মেয়াদ হবে তিন থেকে ছয়মাস। এই সরকারের জন্য আলাদা প্রশাসন থাকবে। এই সরকার কোন নীতি নির্ধারনী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, দুর্যোগ এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা ছাড়া বড় ধরনের কোন কাজ করতে পারবে না। এ সরকারের কাজ হবে রুটিন কাজ।
১৪। নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকার গঠনের পর পূর্বের প্রধানমন্ত্রী নামমাত্র ওই পদে থাকবে। তাঁর প্রশাসনিক কোন ক্ষমতা থাকবে না। আগের সংসদ ও মন্ত্রীপরিষদ বিলুপ্ত ঘোষিত হবে। নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকার সরকার পরিচালনার সকল দায়িত্ব পালন করবে। বিলুপ্ত সংসদের বিরোধী দলের নেতা পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পাবেন।
১৫। গুরুত্বপূর্ণ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকার।
১৬। নির্বাচনকালী অস্থায়ী সরকারের সময়কালে একটি মামলা সংক্রান্ত উচ্চতর কমিটি গঠিত হবে। ওই সময়ে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত দায়েরকৃত সকল মামলা তদন্ত করবে ওই কমিটির নেতৃত্বাধীন প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ। তদন্তের পর মামলাগুলোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হবে। হয়রানিমূলক মামলা করলে এবং সেটি প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৭। নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকারের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলায় সেনাবাহিনীর একটি আলাদা ইউনিট কাজ করবে। তাদের প্রতি বিচারিক দায়িত্বও ন্যস্ত করা হবে।
১৮। নির্বাচনের সময় যে কেউ সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত হলে এবং যে কোন দুটি সংস্থার তদন্তে প্রমাণিত হলে তিনি সকল নির্বাচনে অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
১৯। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, গুমের স্বীকার হয়েছেন, গায়েবী মিথ্যা মামলায় আসামী হয়েছেন তাদের গণতন্ত্র যোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে।
২০। নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকারের সময় সাময়িক সময়ের জন্য বিদায়ী প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদধারীরা তাদের দায়িত্ব থেকে বিরত থাকবে। সেখানে ওই দপ্তরের সেকে- ইন কমা- ওই দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্ব পারনে কোন পক্ষপাতিত্ব প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করতে হবে।
২১। রাষ্ট্রীয় চাকরিতে যোগদানের সময় স্থাবর-অস্তাবর সম্পদের বিবরণ জমা দিতে হবে। প্রতি বছর বছর এই বিবরণী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দিতে হবে। অবসরের সময় একটি বিশেষ কমিটি সার্বিক বিষয়াদি মূল্যায়ন করবে। মূল্যায়নে গড়মিল হলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে বিচার হবে এবং পেনশন বাতিলের বিধান করতে হবে।
২২। দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই হাসপাতালগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পাশাপাশি বিদেশের অভিজ্ঞ ডাক্তারদের সেখানে নিয়োগ দিতে হবে।
২৩। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গৃহীত প্রস্তাবনা অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার ঠিত হবে। রেজ্যুলেশন মোতাবেক এটি নিম্চিত করা হবে। যারা নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্বে থাকবেন তারা পরবর্তিতে রাষ্ট্রীয় কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। পরবর্তি সময়ে তাদের কোন অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে তারা বিচারের সম্মুখিন হবেন।
মোঃ ছাইফুল ইসলাম
চেয়ারম্যান, টিজিএসএস
সোনাতলা, বগুড়া।
তারিখ: ১৫-০১-২৫
Leave a Reply