সোনাতলা সংবাদ ডেস্কঃ- ভয়াবহ মাদক স্কোপোলামিন। অপরাধ জগতে যার নাম ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নি:শ্বাস। বগুড়ায় প্রতারক চক্র এ ধরনের মাদক মানুষের নিঃশ্বাসে প্রয়োগের মাধ্যমে ‘মাইন্ড কন্ট্রোল’ করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। এ চক্রের খপ্পরে পড়ে তাদের হাতে স্বেচ্ছায় নিজের মূল্যবান জিনিসপত্র,সোনার গহনা ও টাকা তুলে দিচ্ছেন অনেকেই।
এতোদিন ঢাকায় এ চক্র তৎপর থাকলেও এখন বগুড়ায় সক্রিয় হচ্ছে এ চক্র। বগুড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ এ মাদক কৌশলে ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে বশীভূত করে সর্বস্ব লুটে নেয়ার ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, যা গা শিউরে ওঠার মত খবর। তাই এখনই এ অপরাধী চক্রের হাত থেকে সাবধান থাকতে হবে জন সাধারণকে।
ক’দিন আগে বগুড়া শহরে একটি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েন মাহবুবা সুরাইয়া নামে এক নারী। চক্রটি তার ওপর কৌশলে ভয়াবহ মাদক স্কোপোলামিন বা ‘শয়তানের নি:স্বাস’ প্রয়োগ করে। পরে এতে তিনি বশীভূত হয়ে পড়েন এবং নিজের হাতেই গলা হতে সোনার চেইন ও কানের দুল খুলে তাদের হাতে তুলে দেন।
গত ১ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুরে জাতীয় সংসদের বগুড়া সদর-৬ উপ-নির্বাচনে ভোট দিয়ে ফেরার পথে শহরের চাঁদনীবাজার এলাকায় ওই সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের কবলে পড়েন তিনি। চক্রের সদস্যরা তাকে সম্মোহিত করে তার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা মূল্যের ১৩ আনা ওজনের সোনার গহনা হাতিয়ে নেয়।
শহরের নাটাইপাড়ার বাসিন্দা মাহবুবা সুরাইয়া বলেন, ওই দিন বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে তিনি তার স্বামী দৈনিক করতোয়ার ক্যাশিয়ার এ.এম রাশীদুল হাসানের সাথে সংসদের উপ-নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য শহরের চেলোপাড়া নাইট স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিয়ে ফতেহআলী বাজারে যান।
এ দিন বেলা ২ টা ১০ মিনিটের দিকে তিনি ফতেহআলী বাজার থেকে গুড় কিনে চাঁদনী বাজারে গিয়ে তোয়ালা কিনছিলেন। কিন্তু এ সময় তিনি ওই ভয়ংকর প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েন। প্রথমে প্রতারক চক্রের হলুদ রং এর শার্ট পড়ে আসে। এরপর তার হাতে থাকা একটি ব্যাগ দেখিয়ে বলে এর ভিতরে কেক বানানোর দামি পাউডার আছে। পাউডারগুলো বিক্রি করতে তার অসুবিধা হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর মাস্ক পড়া চক্রের আরেক সদস্য তার কাছে এসে বলে আপা ছেলেটির মা অসুস্থ, আমরা তাকে সাহায্য করতে পারি। এ সময় তিনি বলেন, আমি তাকে চিনি না। আমি সাহায্য করতে পারবো না। এর ৫ মিনিটের মধ্যে আবার তাদের আরও এক সদস্য সেখানে হাজির হয় এবং পাউডারসহ ব্যাগ খুলে রেখে তার সাথে কথাবার্তা শুরু করে। কিন্ত এক পর্যায়ে তিনি ওই পাউডারের গন্ধে সম্মোহিত হয়ে পড়েন। এরপর তাদের কথামত চলতে শুরু করেন।
এক পর্যায়ে তিনি নিজেই গলা থেকে ১৩ আনা ওজনের একটি সোনার চেইন এবং সোনার দুটি কানের দুল খুলে তাদের হাতে দেন এবং তাদের পিছু পিছু চলতে থাকেন। এরপর তিনি শহরের সাতমাথা এলাকায় বাটার জুতার শোরুমের সামনে নিজেকে আবিস্কার করেন। পরে তিনি ফোন করে বাড়িতে জানালে তার স্বামীসহ পরিবারের লোকজন এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে।
সুরাইয়া বলেন, তার ধারণা,প্রতারক চক্র ব্যাগের মধ্যে যে পাউডার দেখিয়েছিল তা ভয়াবহ মাদক স্কোপোলামিন বা ‘শয়তানের নি:শ্বাস’ হেেত পারে। তারা কাছে এসে ব্যাগ খুলে এটা দেখানোর পর তিনি বশিভূত হয়ে পড়েন। এতে সম্মোহিত হয়ে তিনি তার গলা থেকে সোনর চেইন ও দুটি কানে দুল খুলে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনি। অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নেমেছে পুলিশ।
শুধু এ ঘটনাই নয়, এর আগেও শহরের চেলোপাড়া ও মাটিডালি এলাকায় দু’জন নারী ওই প্রতারক চক্রের কবলে পড়েছিলেন। একই কায়দায় প্রতারক চক্র স্কোপোলামিন নামে মাদক ব্যবহার করে সোনার গহনা ও টাকা হাতিয়ে নেয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতারক চক্রটি চিরকূটে লেখা ঠিকানা জানতে চেয়ে অথবা কারন ছাড়াই হ্যান্ডশেক করতে এসে ‘শয়তানের নি:শ্বাস বা স্কোপোলামিন ছড়িয়ে দিয়ে বশীভূত করেও মানুষের কাছ থেকে সব কিছু হাতিয়ে নিচ্ছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, স্কোপোলামিন নামক ড্রাগ মূলত লিকুইড ও শুকনো ধরণের হয়। এটি হেলুসিনেটিক ড্রাগ। এই ড্রাগ ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। যার প্রতিক্রিয়া থাকে প্রায় ২০ থেকে ৬০ মিনিট। আবার এই মাদক খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে এর প্রতিক্রিয়া থাকে দু-তিনদিন। এ মাদক গ্রহণে ভুক্তভোগীরা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগটি লুফে নেয় প্রতারকরা।
উল্লেখ্য,সম্প্রতি দেশে এক ধরণের নতুন মাদকের উদ্ভব ঘটেছে, যা দিয়ে একজন মানুষের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যায়। এরপর তার কাছে থাকা সোনার গহনা ও দামি জিনিসপত্র নিয়ে নিতে পারে প্রতারক। ঢাকা ও বগুড়াসহ দেশের কয়েকটি জায়গায় এমন ঘটনা ঘটেছে। এটি কিছুটা অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টির মতো মনে হলেও এটি সে রকম নয়। এটি কারও শরীরের ভেতরে গেলে তার কোনো নিজস্ব হিতাহিত জ্ঞান থাকবে না।
প্রতারক যা বলবে তাই তিনি করবেন। অর্থাৎ মানুষ প্রকাশ্যেই মোবাইল, মানিব্যাগ বা টাকা দিয়ে দেবে প্রতারককে। এতে আশপাশের মানুষও বুঝবে না আপনার কাছ থেকে সব লুটে নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে বগুড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, কয়েক দিন আগে বগুড়া শহরের চাঁদনী বাজার এলাকায় প্রতারক চক্র এ ধরনের মাদক বা কেমিকেল ব্যবহার করে এক নারীর কাছ থেকে সোনার গহনা হাতিয়ে নিয়েছে বলে আমরা জেনেছি।
এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে প্রতারক চক্রটিকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপ-পরিচালক পরিচালক মো: রাজিউর রহমান বলেন, আমরা স্কোপোলামিন মাদক সম্পর্কে শুনেছি, কিন্তু এই মাদকের এখনও খোঁজ পাইনি। ঢাকায় প্রতারক চক্র এ ধরণের মাদক ব্যবহার করে সম্মোহিত করে মানুষের কাছ থেকে টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে বলে শুনেছি।
তবে এই মাদকের ব্যবহার বগুড়ায় হচ্ছে কিনা তা জানিনা। এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন থাকতে হবে। বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: শরাফত ইসলাম বলেন, এই মাদকের কারণে যারা ভুক্তভোগী ও দামি জিনিসপত্র খুইয়েছেন তারা সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করুন। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেইসাথে এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।
বগুড়ার মাদক নিরাময় কেন্দ্র রেঁনেসা রিহ্যাব এর পরিচালক আশরাফুল হক তুহিন বলেন, ইতোমধ্যে বগুড়া শহরের দু’এক জায়গায় প্রতারক স্কোপোলামিন বা ‘শয়তানের নি:শ্বাস’ ব্যবহার করে মানুষকে সম্মোহিত করে সোনার গহনা হাতিয়ে নেয়ার খবর পেয়েছি। তিনি বলেন, এই সময়ে সব থেকে বেশি জরুরি নিজের সাবধানতা। রাস্তাঘাটে অপরিচিত সকলের থেকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।
বিশেষ করে জুয়েলারি ও ব্যাংক থেকে বের হবার সময় নারী ও পুরুষ সকলকেই এই ঘটনাগুলো মনে রেখে সাবধান থাকতে হবে। রিক্সার যাত্রী ও পথচারী হবার সময়েও সতর্ক থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, বায়ুবাহিত অজানা সব বিপদ রয়েছে তা থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। সূত্র- দৈনিক করতোয়া।
Leave a Reply