মিনহাজুল বারীঃ বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়া। এছাড়াও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা আর দ্রুত ধনী হওয়ার ফাঁদে পড়ে শিক্ষার্থী, যুবক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই মরণনেশায় আসক্ত হচ্ছেন। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা, বিশেষ করে মোড়ের চা-স্টলগুলোতে প্রকাশ্যে চলছে (মোবাইল লুডু) জুয়ার আসর। এর ফলে অনেক পরিবারে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়, নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে অসংখ্য মানুষ।
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চা-স্টল, মুদি দোকান কিংবা নিরিবিলি কোনো স্থানে তরুণ-যুবকরা স্মার্টফোনে ঝুঁকে পড়ে অনলাইন জুয়ায় মত্ত। লুডু, তিন পাত্তি, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের বেটিং সাইটে তারা হাজার হাজার টাকা বাজি ধরছে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা টিফিনের টাকা, প্রাইভেটের বেতন এমনকি পরিবারের অগোচরে টাকা চুরি করেও এই জুয়ায় অংশ নিচ্ছে। তাদের পাশাপাশি মাইক্রোড্রাইভার, অটোভ্যান চালক, মুদি দোকানি এবং উঠতি বয়সের যুবকরাও এ নেশায় গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। সহজলভ্য হওয়ায় এবং ঘরে বসেও খেলা যায় বলে এর আসক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই মরণনেশার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেকেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী আক্ষেপ করে বলেন, "হামার বন্দুর দেকে প্রথমে কৌতূহলবশত খেলা শুরু করি। পয়লা কিছু টাকা জিতেছিলাম। সেই লোভে পড়ে আরও বড় বাজি ধরতে থাকি। এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ টাকা হেরেছি। বাপের জমানো টাকাও শেষ করেছি, এখন ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরছি।"
সোনাতলা পৌরসভার এক ভুক্তভোগী মাইক্রোড্রাইভার বলেন, "গাড়ির জমার টাকা দিয়ে খেলতে শুরু করি। ভেবেছিলাম কিছু টাকা লাভ হলে সংসারে সচ্ছলতা আসবে। কিন্তু লাভ তো দূরে থাক, নিজের জমানো টাকা, এমনকি গাড়ি মেরামতের টাকাও শেষ করেছি। এখন ঋণের দায়ে জর্জরিত, ঠিকমতো গাড়িও চালাতে পারছি না। পরিবারে সারাক্ষণ অশান্তি লেগেই থাকে।"
এ বিষয়ে সোনাতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিলাদুন নবী বলেন, "অনলাইন জুয়ার বিষয়টি আমাদের নজরে আছে এবং আমরা এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছি। এটি একটি সাইবার ক্রাইম এবং এর চক্রগুলো খুব কৌশলে কাজ করে। আমরা নিয়মিত জুয়ার বিষয়ে অভিযান পরিচালনা করছি এবং ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে আটক করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে শুধু পুলিশি অভিযানে এটি নির্মূল করা কঠিন। এর জন্য সামাজিক সচেতনতা এবং পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখলে পুলিশকে জানানোর জন্য আমরা অনুরোধ করছি।"
এদিকে উপজেলার সচেতন নাগরিক ও সমাজকর্মীরা এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এবিষয়ে উপজেলার বালুয়াহাট ডিগ্রী কলেজের সহকারী অধ্যাপক এটিএম গোলাম রকিব বলেন, "প্রযুক্তির এই অপব্যবহার আমাদের যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। কিশোর-যুবকরা লেখাপড়া ও স্বাভাবিক কাজকর্ম ছেড়ে ভার্চুয়াল জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে, যা সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন কমে যাওয়ায় এই প্রবণতা বাড়ছে। এখনই এটি রোধ করা না গেলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।"
প্রতিকার ও করণীয়:
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
১. আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর পদক্ষেপ: অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো বন্ধ করা এবং এর সাথে জড়িত এজেন্টদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
২. পারিবারিক সচেতনতা: অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের স্মার্টফোন ব্যবহারের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে এর কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
৩. সামাজিক আন্দোলন: স্কুল, কলেজ, মসজিদ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
৪. আর্থিক লেনদেনে নজরদারি: মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।
এলাকাবাসীর দাবি, প্রশাসন যেন দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে সোনাতলাকে অনলাইন জুয়ার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে এবং বিপথগামী তরুণদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়।
সোনাতলা সংবাদে লিখতে পারেন আপনিও। যে কোনও তথ্য ও ভিডিও দিন নিচের WhatsApp নাম্বারে। প্রয়োজনে আপনার নাম ও পরিচয় গোপন রাখা হবে।
মোবাইল: ০১৭৭৪৬৫০৬৭১
E-mail: sonatalasangbad@gmail.com