লতিফুল ইসলাম, সোনাতলা (বগুড়া) প্রতিনিধি: বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগণের বিরুদ্ধে সরকারি বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। ¯িøপের টাকা, ক্ষুদ্র মেরামত, কন্টিজেন্সি, রুটিন মেইনটেন্যান্স ইত্যাদি খাতে বরাদ্দৃকৃত লাখ লাখ টাকা বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে ব্যয় করার কথা থাকলেও ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে নাম মাত্র কাজ করে টাকাগুলো তারা পকেটস্থ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে বরাদ্দকৃত অর্থের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। কর্তৃপক্ষ বলছে, বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পিটিআইসহ উপজেলায় মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১২৪টি। প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে বছরজুড়ে নানা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে কন্টিজেন্সি বরাদ্দ, ¯িøপ বরাদ্দ, ক্ষুদ্র মেরামত বরাদ্দ, রুটিন মেইনট্যান্স বরাদ্দ ইত্যাদি। খাতা, কলম, চক, ডাস্টার তথা স্টেশনারি সামগ্রী ক্রয় করার জন্য বছরে দুই বার কন্টিজেন্সি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই বরাদ্দে প্রত্যেক বিদ্যালয় পায় মোট ৮ হাজার চারশত টাকা।
এছাড়াও ‘স্কুল লেভেল ইমপ্রæভমেন্ট প্লান (¯িøপ) বরাদ্দে প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বরাদ্দ দেওয়া হয় স্কুল ভেদে ৭০,০০০ থেকে ১,০০০০০ টাকা। এই প্রতিবেদকের হাতে আসা নথিতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে সোনাতলার ১২৪টি বিদ্যালয়ের জন্য প্রথম পর্যায়ের ¯িøপ বরাদ্দ এসেছে মোট ৪৫ লক্ষ ৩০ হাজার পয়ত্রিশ টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে এসেছে ২০ লাখ ৩২ হাজার চারশত পয়ষট্টি টাকা। এই বিপুল অংকের টাকা বিদ্যালয়ের উন্নয়ন, শিক্ষা উপকরণ ক্রয় ও বিভিন্ন খাতে ব্যয় করার কথা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় না করে ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে টাকাগুলো প্রধান শিক্ষকগণ নিজেরাই পকেটস্থ করেছেন। শুধু তাই নয়, একই বিল-ভাউচার বার বার প্রদর্শনেরও অভিযোগ রয়েছে কোনো কোনো বিদ্যালেয়ের বিরুদ্ধে।
ক্ষুদ্র মেরামত বরাদ্দে প্রত্যেক বিদ্যালয় বছরে পায় স্কুল ভেদে এক লক্ষ থেকে দুই লক্ষ টাকা। মোটা অঙ্কের এসব বরাদ্দেও ভাগ-বাটোয়ারা চলে সমান তালে। বিদ্যালয়ের নামফলক, নির্দেশিকা ফলক, দেওয়াল রংকরণ, বিভিন্ন দিবসের ব্যানার তৈরি, বেঞ্চ ও দরজা-জানালা মেরামত ও রংকরণ, পরিষ্কার সামগ্রী ক্রয় ইত্যাদির জন্য টাকাগুলো বরাদ্দ দেওয়া হলেও খরচের হিসাব একেবারে ভিন্ন। বেশির ভাগ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক টিও এবং এটিও’কে ম্যানেজ করে কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে ঘুষ দিয়ে টাকাগুলো আত্মসাৎ করছেন।
এছাড়া রুটিন মেইনট্যান্স বরাদ্দে প্রত্যেক বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ বাৎসরিক ৪০,০০০ টাকা। বিদ্যালয়ের তালা, দরজা, টেবিল-চেয়ার মেরামতসহ খুটিনাটি বিভিন্ন জিনিস ক্রয় করার কথা থাকলেও প্রধান শিক্ষকগণ খেয়াল খুশি মতো ভাউচার তৈরি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলার বিশ^নাথপুর, সাতবেকি, ধর্মকুল, রাধাকান্তপুর, রশিদপুর, কামালের পাড়া, আড়িয়া চকনন্দন, বিশুরপাড়াসহ বিভিন্ন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা শোচনীয়। বরাদ্দের টাকাগুলো নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় হয়নি। এমনকি টয়লেটও নাই কোনো কোনো বিদ্যালয়ে। অথচ এসবের জন্য লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
বিদ্যালয়সমূহের এসব বরাদ্দ ঠিকঠাক মতো ব্যয় করা হচ্ছে কিনা এসব দেখভালের দায়িত্ব যাদের সেই উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এনায়েতুর রশীদ ও সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার রেজাউল করিম ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বরাদ্দের লাখ লাখ টাকা নয়ছয়ের এসব ঘটনায় পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা, প্রত্যেকটি বিদ্যালয় থেকে উল্টো তারাই নিয়মিত ভাগ নেন। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে আসা এসব বরাদ্দে একদিকে যেমন সুফল মিলছে না, তেমনি শিক্ষক ও দায়িত্বশীলদের নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
এদিকে শিক্ষক ও তদারকি ব্যক্তিদের এহেন কর্মকাÐে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টরা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘আমাদের সন্তানদের শিক্ষার মানোন্নয়ের জন্য এতো এতো বরাদ্দ আসে কিন্তু শিক্ষক নামধারী দুর্নীতিবাজরা সেই অর্থগুলো নিজেরাই পকেটস্থ করছে। অথচ এই অর্থগুলো যদি যথাযথভাবে খরচ করা যেত, তাহলে প্রাথমিক শিক্ষার মান আরো বৃদ্ধি পেত।’’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. এনায়েতুর রশীদ। তিনি বলেন, ‘‘বরাদ্দের টাকা আত্মসাদের প্রশ্নই ওঠে না। আমরা বিদ্যালয়গুলোকে বরাদ্দ দেই এবং সেগুলোর কাজের প্রমাণ হিসেবে ভাউচার সংগ্রহ করি। এখানে অনিয়মের কিছু হয়নি।’’ এসময় ভাউচার দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে অস্বীকৃতি জানান।
সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, ‘‘আমরা যখন যে বরাদ্দ আসে সেই অনুযায়ী বিদ্যালয়গুলোতে বরাদ্দ দেই। বরাদ্দগুলো ট্রেজারির মাধ্যমে দেওয়া হয় এবং প্রধান শিক্ষকদের হিসাব নম্বরে চলে যায়। এখানে দুর্র্নীতির কোনো সুযোগ নেই। বরাদ্দ যথাযথভাবে দেওয়া হয় না কিংবা কেটে নিয়ে কম দেওয়া হয় কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া কোনো প্রধান শিক্ষক এরকম কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে করে নাই’’।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. রেজোয়ান হোসেনের সাথে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘‘আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। যেখানেই দুর্নীতি হবে, আপনারা আমাকে শুধু তথ্য দেবেন আমি তাৎক্ষনাত ব্যবস্থা নেব।’’ তিনি আরো বলেন, সোনাতলার টিও এবং এটিও’র বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমি আমার উধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
Leave a Reply