সোনাতলা সংবাদ ডেস্কঃ তুরস্কে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘নিউ জেএমবি’র আমির মোহাম্মদ কামরুল হাসান ওরফে মাহাদী হাসান জন ওরফে আবু আব্বাস আল বাঙালি বগুড়ায় ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতি করতেন। তার বিরুদ্ধে বগুড়া জেলায় পাঁচটি নাশকতা মামলা হলে তার বাবা তাকে বিদেশ পাঠাতে মরিয়া হয়ে পড়েন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট ট্যুরিস্ট ভিসায় ইরাকের উদ্দেশে বগুড়া ছাড়েন কামরুল। ওই দিনই বগুড়ার একটি আদালতে নাশকতার মামলায় কামরুল হাসানের হাজিরার দিন ছিল। আদালতে উপস্থিত না হয়ে বগুড়া ছাড়েন। দুদিন পর ২৬ আগস্ট ইরাক পৌঁছান। সেখান থেকে পাকিস্তানি একটি জঙ্গি গ্রুপের সঙ্গে তুরস্ক যান। সেখান থেকে একসময় সিরিয়াতে যান। সেখানে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গি দলের হয়ে কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে আবার তুরস্ক ফিরে আসেন।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, তুরস্কে বসে মাহাদী হাসান জন ওরফে আবু আব্বাস আল বাঙালি পরিচয়ে বাংলাদেশে একের পর এক জঙ্গি হামলার ছক কষেন। জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই প্রায় এক মাস আগে তুরস্কে গ্রেপ্তার হন এই জঙ্গি নেতা। কামরুল হাসানের এই গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি জানে না তার পরিবার। প্রায় এক মাস আগে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মায়ের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয় একটি ইমো নাম্বারে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার জয়পুরপাড়ার মৃত আবু সাইদ ও মোসা. রেহেনা পারভীনের দ্বিতীয় সন্তান এই কামরুল। উপজেলা সদর থেকে মাত্র ২ মিনিটের হাঁটা পথে এক নির্জন একতলা বাড়িতে গত মঙ্গলবার জঙ্গি নেতা আবু আব্বাস ওরফে কামরুলের পরিবারের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে কামরুলের আলী আব্বাস হয়ে ওঠার গল্প।
কামরুলের মা রেহেনা পারভীন জানান, ছোটবেলা থেকেই একটু লাজুক স্বভাবের কামরুলের লেখাপড়া শুরু হয় স্থানীয় শাপলা কেজি কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে। সেখান থেকে দুপচাঁচিয়া পাইলট স্কুল এবং পরে বিদেশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দুপচাঁচিয়া জে কে কলেজের ছাত্র ছিল কামরুল।রেহেনা পারভীন জানান, ১৯৯৩ সাল থেকে তিনি ব্রাক স্কুলের শিক্ষকতা করতেন। কামরুলের বাবা কাঠ ব্যবসায়ী মৃত আবু সাইদ স্থানীয়ভাবে উকিল নামে পরিচিত ছিলেন। ২০১০ সালে কামরুল স্থানীয় শিবিরের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে ২০১১ সালে তাকে এক প্রকার জোর করে ব্রাক স্কুলের চাকরি থেকে ছাড়িয়ে নেন। ২০১৩ সালে কামরুলের নামে বগুড়া জেলায় পাঁচটি নাশকতা মামলা হলে কামরুলের বাবা আবু সাইদ ছেলেকে যে কোনোভাবে বিদেশে পাঠাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এর পর তার বাবা আবু সাইদ স্থানীয় করাতকল ব্যবসায়ী নিরু বসাকের মধ্যস্থতায় ছেলেকে এক দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট ও ইরাকের ট্যুরিস্ট ভিসা জোগাড় করে দেন। এই পাসপোর্ট তৈরি ও ভিসা সংগ্রহের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ যাবতীয় কাজে একটি সিটিসেল ফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়। ওই ফোন নম্বরটির মালিক ছিলেন কামরুলের বাড়ির পাশের রবিন। বর্তমানে ওই ফোনের মালিক ও তার বাবা দুজনেই মৃত। অন্যদিকে মারা গেছে দালাল ম্যানেজকারী নিরু বসাকও।
কামরুলের মায়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট বগুড়ার আদালতে নাশকতার মামলায় কামরুলের হাজিরার দিন ধার্য ছিল। ওই দিন বেলা ৪টার পর কামরুলকে শাহ ফতেহ আলী পরিবহনে তার বাবা তাকে তুলে দেন। এর দুদিন পর ২৬ আগস্ট কামরুল ইরাকে যান। সেখান থেকে পাকিস্তানি একটি গ্রুপের সঙ্গে তুরস্কে যান। এর পর থেকে কামরুল একটি ইমো নম্বরে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। কামরুলের মায়ের মোবাইলে আবু আবদুল্লাহ নামে সেফ করা ওই নম্বরটি হচ্ছে ০১৮৫২৯৮১৯২৩। কামরুলের বাল্যবন্ধু সোহাগ জানান, কামরুল ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন শারীরিক কসরতে আগ্রহী ছিলেন।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কামরুলের বড়ভাই ইমরুল বাড়িতে থাকেন না। ইমরুল ও কামরুল বাড়িতে না থাকলেও তাদের বাড়িতে তাদের দুই ভাইয়ের আলাদা রুম সাজানো-গোছানো আছে। তবে বাড়িতে কামরুলের কোনো ব্যবহারের জিনিস এমনকি ছবি পর্যন্ত নেই। তার মায়ের দাবি, ভয়ে তিনি সব পুড়িয়ে ফেলেছেন। কামরুলের বড় ভাই ইমরুল থাকেন তাদের দাদার বাড়িতে। সেখানে তিনি একটি বেসরকারি বিদ্যালয় হাটনওগাঁ প্রবাহ প্রিক্যাডেট স্কুলের শিক্ষক। রিহান কোচিং সেন্টার নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে তার।
কামরুলের মা দাবি করেন, তার বোন কাহালু উপজেলার মালিপাড়া কাউরাস এলাকার মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী নাশিদা পারভীনের সঙ্গে কামরুলের যোগাযোগ থাকতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে তার সঙ্গে তার ছেলের কথা হয়েছে। তখন তিনি মাকে শরীরের যত্ন নিতে বলেন। এ ছাড়া বেশিরভাগ সময় কামরুল তার ভাবির সঙ্গে কথা বলতেন বলে জানান কামরুলের মা।
জানা গেছে, এই জঙ্গি নেতা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক জঙ্গি হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা ও ইস্তানবুল শহরে বসে বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করতেন তিনি। অনলাইনে এসব হামলার দিকনির্দেশনা থেকে শুরু করে অর্থায়নসহ পুরো কাজ তদারকি করছিলেন।
সিটিটিসির তথ্য বলছে, দেশে থাকাবস্থায় নিউ জেএমবির আমির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল কামরুল হাসান। কামরুলের সাংগাঠনিক নাম মাহাদী হাসান জন। তার বিরুদ্ধে দুপচাঁচিয়া থানায় পাঁচটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মুলতবি রয়েছে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে জঙ্গি হামলার অন্যতম আসামিও তিনি। কামরুল হাসান নিউ জেএমবিতে আবু আব্বাস আল বাঙালি নামেও পরিচিত। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ জেএমবির আমির নির্বাচিত হয় এই জঙ্গি নেতা।-আমাদের সময়
Leave a Reply